রায়হানুল ইসলাম:
“যদি রাত পোহালে শোনা যেত বঙ্গবন্ধু মরে নাই,
যদি রাজপথে আবার মিছিল হতো বঙ্গবন্ধুর মুক্তি চাই!”
১৭ কোটি বাঙ্গালির প্রাণের আকুতি যেন এই গানের কথাগুলো। জাতীয় শোক দিবসের শিরোনাম সংগীত হয়ে উঠা গানটিতে মিশে আছে বাঙ্গালি জাতির হৃদয়ের আর্তনাদ। ১৫ আগস্ট তারিখটা আজ লাল সবুজের জন্য এক ঘৃণিত তারিখ, লজ্জার তারিখ। নিজেদের সম্ভ্রম নিজেরাই কেড়ে নেবার রক্তাক্ত ইতিহাস। এই দিনে বাংলাদেশ, মাটি-মানুষ, ধূলিকণা কেঁদে উঠে পিতা হারানোর ক্ষত নিয়ে, দিগ্বিদিক ফাটানো আর্তচিৎকারে।
বাঙ্গালি জাতির কাছে বঙ্গবন্ধু, জাতির পিতা, জাতির জনক, লাল-সবুজ, বাংলাদেশ এই শব্দগুলো প্রতিটিই সমার্থক। মহাত্মা গান্ধীকে বাদ দিয়ে যেমন ভারতের ইতিহাস লেখা যায় না, মাও সেতুংকে বাদ দিয়ে চীনের, হো চি মিনকে বাদ দিয়ে ভিয়েতনামের ইতিহাস লেখা যায় না, জর্জ ওয়াশিংটনকে বাদ দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস লেখা যায় না, তেমনি বঙ্গবন্ধুকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশের ইতিহাস লেখা যায় না। তিনি “বজ্রকন্ঠ “, তিনি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালি, তিনি স্বাধীন সার্বভৌম লাল সবুজের রুপকার।
১৯৭৫-এর ১৫ই আগস্টের শোকাবহ ঐ কালো দিনের ভোররাতে সেনাবাহিনীর কিছুসংখ্যক বিপথগামী সদস্য ধানমন্ডির বাসভবনে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে। ঘাতকরা শুধু বঙ্গবন্ধুকেই হত্যা করেনি, তাদের হাতে একে একে প্রাণ হারিয়েছেন বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, বঙ্গবন্ধুর সন্তান শেখ কামাল, শেখ জামাল ও শিশু শেখ রাসেলসহ পুত্রবধূ সুলতানা কামাল ও রোজী জামাল। পৃথিবীর এই জঘন্যতম হত্যাকাণ্ড থেকে বাঁচতে পারেননি বঙ্গবন্ধুর অনুজ শেখ নাসের, ভগ্নীপতি আবদুর রব সেরনিয়াবাত, তার ছেলে আরিফ, মেয়ে বেবি ও সুকান্তবাবু, বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে যুবনেতা ও সাংবাদিক, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক শেখ ফজলুল হক মনি, তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আরজু মনি এবং আবদুল নাঈম খান রিন্টু ও কর্নেল জামিলসহ পরিবারের ১৬ জন সদস্য ও ঘনিষ্ঠজন। এ সময় বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা বিদেশে থাকায় প্রাণে রক্ষা পান।
সেদিন সূর্য উঠেনি লাল সবুজের, বাঙ্গালি জাতিকে অন্ধকারে নিমজ্জিত করে দেওয়ার প্রয়াস ছিলো ঐ ভোরের নিস্তব্ধতায় । দেশের নির্বাচিত রাষ্ট্রপ্রধানকে পরিবারের সদস্যসহ এরূপ ভয়াবহভাবে হত্যার ঘটনা দুনিয়ার ইতিহাসে বিরল। ঘাতক খুনী-চক্র এমন বর্বর হত্যাযজ্ঞের মাধ্যমে চিরতরে স্তব্ধ করে দিতে চেয়েছিল স্বাধীন বাংলাদেশের অগ্রগতিকে। কিন্তু মহানায়কেরা মরেনা, তাদের স্বপ্ন বেঁচে থাকে। তাইতো বঙ্গবন্ধুর অস্তিত্বে লালিত রক্তধারা দেশরত্ন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে জাতি আজ বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলার স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথে।
বঙ্গবন্ধুকে দৈহিকভাবে হত্যা করা হলেও তার মৃত্যু নেই। তিনি চিরঞ্জীব। তিনি বাঙ্গালী জাতিরাষ্ট্রের স্বপ্নদ্রষ্টা এবং স্বাধীন বাংলার স্থপতি। যতদিন এ রাষ্ট্র থাকবে, ততদিন অমর তিনি।
একজন বিশ্লেষক বলেন: ‘আমি গান্ধী, জিন্নাহ, ও নেহেরুর রাজনীতি এবং জনসম্পৃক্ততা দেখেছি । কিন্তু মুজিব লক্ষ লক্ষ মানুষের মাঝে যে প্রেরণা জাগিয়ে তুলতে পারতেন, তার কোন তুলনা হয়না । তার আকর্ষনীয় ব্যক্তিত্ব ও প্রভাবিত করার ক্ষমতা, তা অন্য কোনো নেতার কখনোই ছিলোনা’।
শেখ মুজিব শুধু একটা নাম নয়, একটা বিশ্বাস, একটি জাতির প্রেরণা, আবেগকে নাড়িয়ে দেয়া একটা পবিত্র অনুভূতি। শোকাবহ ১৫ আগস্ট এ বাঙ্গালী জাতির হৃদয় থেকে “জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু” স্লোগানে মুখরিত হবে বাংলা মাটির প্রতিটি ধূলিকণা। অন্তরাত্মা কেঁদে কেঁদে বলে উঠবে-
“মরিয়া অমরত্ব লভিয়াছো, হে জ্যোতির্ময়;
আজ তোমারই হোক জয়”
লেখক : প্রভাষক, উইমেন্স মডেল কলেজ, সিলেট (ইংরেজি)।
মন্তব্য করুন